Story Behind a Photo 4

ছবির পেছনের গল্প ৪



#StoryBehindAPhoto #rezakabir #story


জানুয়ারিতে গেলাম কক্সসবাজার বেড়াতে। এবার মোটামুটি একটা প্রস্তুতি নিয়েই গেলাম। প্লান ইনানী বিচের আসেপাশে মাছ ধরা সাম্পান নৌকা এবং সুর্যাস্তের ছবি তোলা। Sun Seeker App এবং Google Map এর সাহায্যে কিছুটা ধারনা নিয়ে নিলাম লোকেশন সম্মন্ধে। মোটিমুটি একটা মেন্টাল ম্যাপ মাথায় বেধে নিয়েছিলাম যে কোথায় কি থাকতে পারে এবং কোথায় কখন সুর্য মামা থাকবেন। যে কোন Landscape photographer এর জন্য এই প্রস্তুতিটা খুব জরুরি। আমি যে কোন যায়গায় , দেশে কিংবা বিদেশে যাবার আগে এই প্রস্তুতিটা অবশ্যই করে নেই যদি ছবি তেলার সিরিয়াস প্লান থাকে।


Landscape ছবি তোলার জন্য আপনার ব্যাগে অবশ্যই নুন্যতম, ওয়াইড অ্যাংগেল লেন্স, ট্রাইপড, ND ফিল্টার এবং Polarization ফিল্টাের থাকতেই হবে। লেন্স 24mm কিংবা তার কম হলে ভালো তবে আমি অনেক সময় আরো বেশি ফেকাল লেন্থের লেন্সও ব্যাবহার করেছি। লার্জ প্যানরোমা আমি সাধারনত লং ফোকাল লেন্থ দিয়েই তুলি। পাশাপাশি কয়েকটি ছবি তুলে পোস্টে একসাথে করি।  Tripod শক্ত হওয়া খুবই প্রয়োজেন। এখানে কিপটামি করা যাবে না। ND ফিলটার 3 থেকে 11 stop পর্যন্ত হতে পারে। ভালো ব্রান্ডের ND হওয়া প্রয়োজনিয়। না হলে ছবিতে কালার ফ্রিন্জ এবং কালার কাস্টিং আসতে পারে যা পোস্ট প্রসেসিং করেও দুর করা কস্টকর হয়ে পরতে পারে।


আমার সাথি ছিলো প্রিয় Nikon D800 ক্যামেরা। আর সাথে নিয়েছিলাম ১৪-২৪ f/২.৮ এবং ২৪-৭০ f/২.৮ লেন্স। সমস্যা হল, আমার সাথে শুধু ২৪-৭০ এর জন্য Heliopan 77mm Variable Gray ND Filter ছিলো. এটি ১ থেকে ৬ stop পর্যন্ত আলো থামাতে পারে। সাথে আরো ছিলো বহুদিনের সাথি Manfrotto Tripod. এটি D800 with 400mm লেন্স setup কেও ছেলেখেলার মতো নিশ্চলভাবে ধরে রাখতে পারে।


আমি থাকছিলাম টিউলিপ রেসর্টে। মূল শহর থেকে একটু দুরে এই জায়গাটা আসলেই Landscape photographer দের স্বর্গ বলে আমার মনে হয়েছে।

সুর্যাস্তের ছবি প্রতিদিনই তুলছিলাম আর প্রস্তুতুতি নিচ্ছিলাম সাম্পানের ছবি তোলার জন্য। লক্ষ করলাম ইনানি বিচে ঢোকার পথে একটা ছোট ব্রীজ আছে। ব্রীজ উঠার আগে বামে গেলে আমার হোটেল আর সোজা গেলে সৈকত। তবে ব্রীজের পাশ দিয়ে থেকে নিচে নেমে গেলে বেশ দুরে নিশ্চুপ একাকি সাগর সৈকত। যাবার পথে অনেক গুলো সাম্পান সাগরের আগেই বালু এবং ডোবা পানিতে রাখা আছে। ডোবা গুলো হচ্ছে সাগর থেকে জোয়ারে পানি এসে ছোট নালার মত । প্রতিদিন ব্রীজের পাশ দিয়ে যাই এবং লক্ষ করি কোথায় কি আছে এবং পথের আবস্থা। পৌছানোর সহজ কোন পথ নাই। আমাকে বেশ কিছু নালা ডোবা পাড় করতে হবে এবং যথেস্ট হাটতে হবে লোকাশনে পৌছানোর জন্য। দুই দিন গাড়ি থেকে নেমে, ব্রীজ এবং রাস্তায় দাড়িয়ে সাবধানে পর্যবেক্ষন করলাম। এরমাঝে একদিন অনেক সকালে উঠে হোটেলের আশেপাশে হেটে সুর্য এবং পরিবেশ বুঝে নিলাম। যেমন কি পরিমান লোকজন আশেপাশে থাকে, সৈকতের দিকে যেতে কোন বাধা আছে কিনা etc.  প্রস্তুতি শেষ :)


নিদ্রিস্ট দিনের আগের দিন ব্রীজের কাছে দাড়িয়ে, Sun Seeker App টি দিয়ে দেখে নিলাম পরের দিন সুর্যদয় হবে ৬.৪০ এ। সুর্য কোন যায়গা দিয়ে উঠবে তাও দেখে নিলাম। আমি হেটে হেটে নিজের অবস্থানের সাথে কোন দিকে তাকালে পরের দিন কোথায় কিভাবে সুর্য দেখতে পাবো তা বুঝে নিলাম। নিজেকে মানষিক ভাবে তৈরি করে নিলাম। App টি অসাধারন এসব কাজের জন্য। Landscape photographer দের ফোনে এটি থাকা আবশ্যক বলে আমি মনে করি। কক্সসবাজারে সুর্যদয় হয় সাগরের উল্টা দিক থেকে। তাই সাগর এবং সুর্যকে সকাল বেলা একসাথে ক্যামেরাতে বন্দি করা সম্ভব নয়। এজন্যই এখানে সাধারণত সবাই সুর্যাস্তের ছবিই তোলে।


হোটেলে ফিরে ব্যাগ গুছিয়ে ফেল্লাম। Vanguard Uprise II 48 ব্যাগিটি এধরনের সিচুয়েসনের জন্য আমি ব্যাবহার করি। তাই এবার এটি সাথে নিয়ে এসেছি। এই ব্যাগটি আমি নিয়মিত ব্যাবহার করি না, তবে এতে সহজে বড় ক্যামেরা , বড় দুইটি লেন্স , ফিলটার এবং অন্যান্য আনুসাংগিক জিনিসপত্র সহজে এটে যায়। আমার ছোট ভাই সাথে ছিলো। সেও যেতে চাইলো। অনেকটা এডভেন্চারের মত কিছু একটা হবে বলে সে ভাবছিলো মনে হয় । আর আমি ভাবলাম এবার আমার ভাই বুঝতে পারবে landscape photographer রা কত কস্ট করে :) 


ঠিক ৫.০০ টায় এলার্ম এর শব্দে ঘুম থেকে উঠে গেলাম। ছোট ভাইকে ফোন দিয়ে রেডি হয়ে গেলাম। গাড়িকে আগে থেকেই আসতে বলা ছিলো। স্পন্জের সেন্ডেল, জিন্স আর টি সার্ট পড়ে রওনা দিলাম। কাধে ব্যাগ এবং হাতে ট্রাইপড। জায়গাটি হোটেল থেকে বেশ কাছে তাই দ্রুত পৌছে গেলাম। আশেপাশে কেউ নেই। আলো ভালোই আছে। অসাধারন বাতাস আর পরিবেশ দেখে বেঝা যায় কেন Landscape photographer রা এতো কস্ট করেও খুশি থাকে।


ব্রিজের পাশ দিয়ে কঠিন পথ দিয়ে আমাদের নামতে দেখে গাড়ির চালকতো অবাক। সেও আমাদের সাথে রওন দিলো। বোধ হয় দেখতে চায় কিছু শহুরে ছেলে কি পাগলামি করে !


পানি কাদা মাটি পাড়িয়ে এগিয়ে গেলাম। সেন্ডেল বহুবার পানির ভেতর কাদাতে আটকে গেলো কিন্তু আমাদের চলা থামলো না। ঘড়িতে ৬.১৫ বাজে। Landscape photographer হলে জানতে হবে সুর্যদয়ের সময় কি কি হয় এবং আলো কেমন আচারন করে। সুর্যদয়ের প্রায় ৩০ মিনিট আগ থেকে শুরু হয় Blue Hour. এটা প্রায় ১০ মিনিট স্থায়ি হয়। আসাধারন আলো থাকে এ সমায়টিতে। পোর্টেট এবং ফ্যাশন ফোটোগ্রাফির জন্য আলোটা অসাধারন। যাকে বলা হয় Flattaring light.  তাই প্রফেশনাল ফটোসুট গুলো এসময়ই সাধারনত হয়ে থাকে। এর পরবর্তি ১৫ মিনিটের মাঝেই আপনি সুর্যকে দেখতে পাবেন। এই ১৫ মিনিট এবং সুর্যকে দেখতে পাবার পর আরো ১৫ মিনিট হলো Golden Hour. এই আলোতে থাকে হলুদ কমলা একটা কালার টোন। এটার কোয়ালিটি আমি বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন দেখেছি ! এই সময়টা শেষ হলে আলো ভালো ছবি নেবার তেমন অনুকুলে থাকে না। অতএব সময় খুব কম থাকে। এত প্রাক-প্রস্তুতি এ জন্যই।


বেশ কিছু সাম্পানের ছবি নিলাম। আমি ১৪-২৪mm লেন্সটি ব্যাবহার করছিলাম। এগুলো সবই টেস্ট সট বলা যেতে পারে। হাতে ক্যামেরা নিয়ে তুলছিলাম। এরপর দেখতে পেলাম কিছু সাম্পান পানির মাঝে। আমি লং এক্সপোজারে তোলার সিদ্ধান্ত নিলাম। এর জন্য ND filter ব্যাবহার করতে হবে যাতে ক্যামেরাতে আলো কম ঢুকে। লেন্স পরিবর্তন করে লাগালাম ২৪-৭০mm. সামনে ND filter এবং polarization filter আগে থেকেই লাগানো আছে। ট্রাইপডে ক্যামেরা বসিয়ে নেমে যেতে হলো কোমর পানিতে। ঠান্ডাতে জমে যাবার মতো অবস্থা। নিচু হয়ে তোলার জন্য আমার বুক পর্যন্ত ডুবে গেল। কিছুই করার নাই। আমার প্রোফাইল এলবামে এ অবস্থার কিছু ছবি থাকার কথা।


কিছু ছবি তোলার পরও, আমি মনে মনে যে ছবিটা কল্পনা করছিলাম তা পাচ্ছিলাম না। অনুকুল আলোর সময় প্রায় শেষ । মনটা একটু খচ খচ করছে। বেশ ভালো কয়েকটি ছবি তুলেছি কিন্তু সেই মনের ছবিটি হয় নাই। এর মাঝে চার পাচটি ছোট বাচ্চা এসে আমার কান্ড কারখানা দেখছে। পানি থেকে উঠে এসে ওদের সাথে গল্প করতে করতে ওদের কিছু ছবি নিলাম। ফিরে যাবার জন্য হাটতে শুরু করলাম ব্রিজের দিকে। তখনি চোখে পড়লো নিশ্চল পানির মাঝে এই ছবির সাম্পানটি। সাগর পাড় থেকে একটু দুরে হওয়ায় এখানে বাতাস কম । তাই পানি একদম নিশ্চল কাচের মতো হয়ে সাম্পানের একটা সুন্দর প্রতিচ্ছবি দিচ্ছে। একটু চারপাশে হেটে ছবি কোনখান থেকে তুলবো এই সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেল্লাম। আবারো কোমর পানিতে নামতে হলো। Triop কে শক্ত করে পানির নিচের মাটিতে গাথলাম। এপারচার f/১৪ এবং ND filter 6 stop. অতএব এপারচার আসলে হলো f/২০. ISO ৫০ তে রাখা আছে। সাটার স্পিড ১৪ সেকেন্ড । সাটার স্পিড পরিবর্তন করে কয়েকটি ছবি নিলাম। আমি একটু নড়লেই পানিতে ঢেউ উঠছে যা চাইছিলাম না। একবার নড়লে, আমাকে প্রায় কয়েক মিনিট নিশ্চল দাড়িয়ে থাকতে হয়েছিলো পানিকে আবার নিশ্চল করবার জন্য। ধৈর্যের সর্বচ্চ পরীক্ষা চলছিলো :) এমন সময় দুইজন দুর থেকে হেটে আসতে থাকলো। ওরা আমার ফ্রেমের মাঝে ছিলো। তাই অপেক্ষা করছিলাম ওদের প্রস্থানের। খুবই ধীরে হাটছে তারা। বেশ বিরক্ত অনুভব করছিলাম। কিন্তু কিছু করার নাই। আমি ওদের এখানে বহিরাগত তাই আমাকেই যথাযথ রেসপেক্ট দেখাতে হবে এদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতি। ওরা যখন পানির পাশ দিয়ে হাটছিলো তখন আইডিয়াটা মাথায় এলো। দ্রুত সাটার ১/৬০ এবং এপেরচার f/৮ এ নিয়ে দুইটি ছবি নিলাম। টার্গেট হলো এদেরকে ফ্রামে বন্দি করা। ক্যামেরার সেটিং পরিবর্তন করতে হলো যাতে তাদের মোশন ফ্রিজ হয়। সাটার যত কম রাখা যায় সে চেস্টাই ছিলো কারন আমি পানিতে বেশি রাফনেস চাইছিলাম না। এব্যাপারাটা নিয়ে একটা ভিডিও আছে আমার পেজে। আমি অরিজিনাল Raw image গুলো দিয়ে দেখিয়েছি কিভাবে লম্বা সাটার স্পিড পানির মাঝে একটা পরিবর্তন আনে।


পোস্ট প্রসেসিং এ এসে আমি ১৪ sec এর সাম্পানের ছবিকে প্রাইমারি ছবি ধরে, ১/৬০ sec  ছবি থেকে মানুষ দুইজনকে নিয়ে ফাইনাল ছবিটি তৈরি করলাম। ফটোশপে কাজটি সহজে করা যেতে পারে। আমিতো ১/৬০ sec ছবিটিই শুধু ব্যাবহার করতে পারতাম ? কিন্তু কেন আমি দুইটি ছবিকে ব্লেন্ড করলাম? ব্যাপারটি না বুঝলে নিচে comment  করুন। তবে আমার এই ভিডিওটি আগে দেখে নিতে বলবো।  https://www.facebook.com/rezakabir/videos/1786664728323285/


ফাইনাল ছবিটি যখন দেখলাম তখন মনে হলো “It was all worthwhile”